Wednesday, July 20, 2011

খুনি বিপ্লবকে ক্ষমা প্রসঙ্গে বিশিষ্টজন : রাষ্ট্রপতি ক্ষমতার অপব্যবহার করেছেন

লক্ষ্মীপুরের বিশিষ্ট আইনজীবী ও জেলা বিএনপির সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক অ্যাডভোকেট নুরুল ইসলামকে
নৃশংসভাবে হত্যার পর লাশ টুকরো টুকরো করে নদীতে ভাসিয়ে দেয়া মামলার অন্যতম আসামি এইচএম বিপ্লবের ফাঁসির দণ্ড রাষ্ট্রপতি মওকুফ করে দেয়ার সিদ্ধান্ত আইনের শাসনকে ব্যাহত করবে বলে মনে করছেন দেশের আইন বিশেষজ্ঞ ও রাজনীতিবিদরা। একাধিক মামলার সাজাপ্রাপ্ত আসামি বিপ্লবের দণ্ড মওকুফ করে দেয়া একটি খারাপ দৃষ্টান্ত বলেও মন্তব্য করে বিশিষ্ট ব্যক্তিরা বলেছেন, এতে আইনি শাসনের প্রতি মানুষের আস্থা কমে যাচ্ছে। মানুষ নিজ হাতে আইন তুলে নিচ্ছে। সম্প্রতি সাভারের নৃশংস ঘটনায় এর নজির মিলেছে। তারা আরও বলেন, সংবিধানে যে কোনো আসামিকে ক্ষমা করে দেয়ার ক্ষমতা ও এখতিয়ার রাষ্ট্রপতির রয়েছে। কিন্তু ফাঁসির আসামি বিপ্লবের দণ্ড মওকুফ করে তিনি সাংবিধানিক ক্ষমতার অপব্যবহার করেছেন। এতে নৃশংস হত্যাকাণ্ডের শিকার নুরুল ইসলামের পরিবার ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হলো। প্রসঙ্গত, লক্ষ্মীপুর আওয়ামী লীগের বিতর্কিত নেতা তাহেরের তিন ছেলে বিপ্লব, লাবু ও টিপুর নেতৃত্বে নুরুল ইসলামকে ২০০০ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর রাতে লক্ষ্মীপুরের পৌর এলাকার মজুপুরের বাসা থেকে অপহরণ করা হয়। ওই রাতেই তাহেরের বাসায় তার স্ত্রী নাজমা তাহেরের উপস্থিতিতে নুরুল ইসলামকে জবাই করা হয়। এরপর লাশ টুকরো টুকরো করে বস্তায় ভরে মেঘনা নদীতে ফেলে দেয়া হয়।
বিশিষ্ট আইনজীবী ব্যারিস্টার রফিক-উল হক অ্যাডভোকেট নুরুল ইসলামের হত্যাকারি বিপ্লবকে ক্ষমা করা প্রসঙ্গে বলেন, রাষ্ট্রপতির ক্ষমা করার ক্ষমতা আছে। কিন্তু আইনমন্ত্রী ও প্রধানমন্ত্রীর সুপারিশে যেভাবে রাষ্ট্রপতি ফাঁসির আসামি খুনিদের ক্ষমা করে দিচ্ছেন, সেটা জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য হচ্ছে না। এটা খুবই খারাপ দৃষ্টান্ত হচ্ছে। তিনি বলেন, রাষ্ট্রপতির ক্ষমা করে দেয়ার ক্ষমতা রাখা হয়েছে, তবে এটাকে যেভাবে অপব্যবহার করা হচ্ছে তা শোভনীয় নয়। এখন দেখা যায়, খুন করে ফাঁসির আসামিরা পালিয়ে বেড়ায়, কখন তাদের সরকার ক্ষমতায় আসবে এবং রাষ্ট্রপতির ক্ষমা পেয়ে তারা মুক্তি পাবে। মুক্তির আশায় ফাঁসি কার্যকর না করে নানা কৌশলে এটা বিলম্বিত করা হচ্ছে। ব্যারিস্টার রফিক-উল হক মনে করেন, রাষ্ট্রীয়ভাবে আমাদের এ জাতীয় মনোভাব পরিহার করা উচিত।
বিপ্লবের দণ্ড মওকুফ প্রসঙ্গে কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ সভাপতি বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বলেন, আমি চাই দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হোক। যে কোনো মামলা স্থগিত, দণ্ড কমিয়ে দেয়া বা মওকুফ করার এখতিয়ার সংবিধানে মহামান্য রাষ্ট্রপতিকে দেয়া হয়েছে। রাষ্ট্রের স্বার্থে রাষ্ট্রপতি এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। কিন্তু ইদানীংকালে যত্রতত্রভাবে তিনি অনুকম্পা বা দণ্ড মাফ করছেন। আইনের শাসন ব্যাহত করছেন। তিনি আরও বলেন, এতে সমাজে মারাত্মক প্রভাব পড়ছে। যাদের বাহুবল বা সরকারি ক্ষমতা রয়েছে, তাদের মধ্যে অপরাধ প্রবণতা বাড়ছে। তাই রাষ্ট্রের স্বার্থ না থাকলে শুধু দল বা ব্যক্তির স্বার্থে খুনিদের সাজা মাফ করা ঠিক হচ্ছে না।
সুপ্রিমকোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশন সভাপতি অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, সরকার একদিকে বিরোধীদলীয় নেতাকর্মী ও সাধারণ মানুষের নামে হাজার হাজার মামলা দিচ্ছে, অপরদিকে সরকারি দলভুক্ত সন্ত্রাসী ও খুনের মামলার আসামিদের নামে দায়ের করা মামলা নির্বাহী ক্ষমতাবলে বাতিল করছে। মামলা বাতিলের যে প্রক্রিয়া চলছে, তাতে মানুষ আইনের প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলছে। সাধারণ মানুষের মধ্যে আইন হাতে তুলে নেয়ার প্রবণতা বাড়ছে। সাভারে ৬ ছাত্রকে পিটিয়ে মারাসহ সাম্প্রতিককালের নানা ঘটনায় এর প্রমাণ দেখতে পাচ্ছি। তিনি আরও বলেন, সংবিধানে রাষ্ট্রপতিকে দণ্ড মওকুফের এখতিয়ার দেয়া আছে। কিন্তু বিশিষ্ট আইনজীবী নুরুল ইসলাম খুনের মামলার ফাঁসির আসামি বিপ্লবের দণ্ড মওকুফ করে তিনি সাংবিধানিক ক্ষমতার অপব্যবহার করেছেন। এতে নৃশংস হত্যাকাণ্ডের শিকার নুরুল ইসলামের পরিবার ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হলো। দেশের ইতিহাসে এটি একটি খারাপ নজির হয়ে থাকবে।
ঢাকা আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি অ্যাডভোকেট সানাউল্লাহ মিয়া বলেন, খুনের আসামিদের ক্ষমা করে দেয়ায় ইতিহাসে এক জঘন্য নজির স্থাপিত হলো। রাষ্ট্রপতি কী কারণে কোন অবস্থায় খুনিদের ক্ষমা করেছেন জানি না। তিনি খুনিদের আরও শক্তি-সামর্থ্যসহ সমাজে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। এতে সমাজে অপরাধ বাড়বে। আইনের প্রতি মানুষের শ্রদ্ধা ও ভয় কমবে। নতুন গডফাদার সৃষ্টি হবে।
আ.স.ম. আবদুর রব বলেন, সংবিধানে রাষ্ট্রপতিকে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিকে ক্ষমা করে দেয়ার ক্ষমতা দেয়া আছে। দল, জনমানুষ ও জাতীয় আকাঙ্ক্ষার কোনটিকে তিনি প্রাধান্য দেবেন, তা তিনিই ভালো জানেন। তিনি একজন প্রবীণ রাজনীতিবিদ। আমি আশা করি মহামান্য রাষ্ট্রপতি জনগণের আকাঙ্ক্ষা ও অনুভূতি সমুন্নত রাখবেন। জনগণও এটা প্রত্যাশা করে। তিনি আরও বলেন, সাক্ষী-প্রমাণের ভিত্তিতেই নুরুল ইসলাম হত্যা মামলায় বিপ্লবের ফাঁসির রায় দিয়েছিলেন বিচারিক আদালত।
(আমারদেশ পত্রিকা থেকে)

No comments:

Post a Comment